জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভেঙে দু’টি বিভাগ: স্বার্থের দ্বন্দ্ব হ্রাসে কাঠামোগত রূপান্তর।
ঢাকা, ১৩ মে ২০২৫:
বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঐতিহাসিক রদবদলের পথে হাঁটল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দীর্ঘদিনের কাঠামোগত অসঙ্গতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব দূর করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের ঘোষণা এসেছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল একটি প্রশাসনিক পুনর্গঠন নয়, বরং দেশের রাজস্ব কাঠামোতে ন্যায়ভিত্তিক ও দক্ষ সংস্কারের ভিত্তি গড়ে তোলার প্রত্যয়। নতুন এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য—নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে ভিন্ন ভিন্ন হাতের হাতে দিয়ে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
কেন এই ভাঙন?
প্রায় পাঁচ দশক আগে প্রতিষ্ঠিত এনবিআর ধারাবাহিকভাবে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ৭.৪ শতাংশের ঘরে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও অন্যতম নিম্নতম। উন্নয়নের জন্য এই অনুপাতকে অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এ লক্ষ্য অর্জনে এনবিআরের একক কাঠামো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বর্তমান ব্যবস্থায় রাজস্ব নীতি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল একই প্রতিষ্ঠানের ওপর, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি ও অদক্ষতার জন্ম দিয়েছে। নীতি নির্ধারক যখন নিজেই রাজস্ব আদায়কারী, তখন স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থ প্রায়শই পেছনের সারিতে চলে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর চিত্র:
কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট: কর আইন ও হার নির্ধারণের পাশাপাশি বাস্তবায়নেও একক কর্তৃত্ব এনবিআরের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জবাবদিহির অভাব তৈরি করেছে।
দুর্বল কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন: কর কর্মকর্তাদের কাজ মূল্যায়নের কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই, ফলে কর্মদক্ষতা ও পেশাদারিত্বে স্থবিরতা এসেছে।
ধীর গতির কর আহরণ: নীতি ও ব্যবস্থাপনা এক ছাতার নিচে থাকায় উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকারিতা কমে গেছে।
দুর্বল শাসন ও আইনের শাসনের অভাব: বিনিয়োগের পরিবেশে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রধান একইসাথে এনবিআরের প্রধান হওয়ায় প্রশাসনিক ওভারল্যাপ ও সিদ্ধান্তহীনতা বেড়েছে।
পুনর্গঠনের সম্ভাব্য সুফল:
নতুন গঠিত রাজস্ব নীতি বিভাগ এখন থেকে কেবল কর আইন, হার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কর চুক্তির দায়িত্বে থাকবে। অপরদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর আদায়, নিরীক্ষা এবং বাস্তবায়নের কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
এই দায়িত্ব বিভাজনের ফলে—
নীতির সঙ্গে বাস্তবায়নের স্বার্থের সংঘর্ষ কমবে.
কর আদায়ের পেশাগত দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে.
কর ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত হবে.
প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দিয়ে করের আওতা বৃদ্ধি পাবে.
দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনৈতিক কৌশল গড়ে তোলা সম্ভব হবে.
ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি:
এই রূপান্তর শুধুমাত্র কাগজে কলমে একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয়। বরং এটি এক ধরনের মানসিকতা পরিবর্তনের সূচনা—যেখানে কর ব্যবস্থাপনা কেবল রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যম নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি।
বিশ্বস্ত, কার্যকর ও স্বচ্ছ কর প্রশাসনই দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে পারে, যা বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং জনগণের আস্থা ফেরানোর পথ খুলে দেবে।