যুদ্ধের পাঠশালা থেকে শহীদ স্মরণ: এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়ে বাংলাদেশের নাম।
নবজাগরণ ডেস্ক | ১১ জুন ২০২৫,
একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড—ফিলিস্তিন। আরেকটি দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান রাষ্ট্র—বাংলাদেশ। দুটি ভিন্ন ইতিহাস, ভিন্ন ভূগোল; কিন্তু একটি অসাধারণ মানবিক চুক্তি তাদের মিলিয়ে দিয়েছিল এক সাহসিকতার বন্ধনে। সেই চুক্তির নেপথ্যে ছিলেন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র। যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল একটি আন্তর্জাতিক সাহসিকতার অধ্যায়—বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে পাহাড়ি ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছিল একদল তরুণ যোদ্ধা, যারা স্বপ্ন দেখেছিল নিজের মাতৃভূমিকে রক্ষা করার।
চুক্তির পটভূমি ও প্রস্তুতি:
১৯৭০ ও ৮০ এর দশকে বিশ্বের দৃষ্টি যখন ফিলিস্তিন সংকটের দিকে নিবদ্ধ, তখন বাংলাদেশ নিজেদের সশস্ত্র বাহিনিকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ফিলিস্তিনের সঙ্গে সম্পাদিত হয় এক ঐতিহাসিক সামরিক প্রশিক্ষণ চুক্তি।
এই চুক্তির আওতায় ৩০ জন ফিলিস্তিনি তরুণকে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (BMA)-তে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর যাদের মধ্যে ৭ জন চূড়ান্তভাবে কমিশন লাভ করেন।
তারা ছিলেন শুধু যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়, বরং বাস্তব যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় গড়ে ওঠা যোদ্ধা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, শিশু বয়সেই গুলি-বারুদের শব্দে ঘুম ভাঙা মানুষগুলোকে বাংলাদেশ আপন করে নেয়।
BMA কর্তৃপক্ষ শুরুতে কিছুটা চ্যালেঞ্জ অনুভব করলেও, দ্রুতই এই তরুণ যোদ্ধারা নিজেদের দক্ষতা, দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলা দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে।
ফিরে যাওয়া এবং ট্র্যাজেডি:
তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়, তারা দেশে ফিরে যায়—ফিরে যায় স্বপ্ন নিয়ে, স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। কিন্তু সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
ইসরায়েলের berüchtigt (বিখ্যাত-কলঙ্কিত) গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ আগে থেকেই সচেতন ছিল এই ক্যাডেটদের সম্পর্কে। তারা জানত, বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় কিছুই করা সম্ভব নয়। তাই মোসাদ অপেক্ষা করেছিল যেদিন তারা নিজেদের মাতৃভূমির মাটিতে পা রাখবে—ঠিক সেদিন থেকেই মৃত্যু ও নিখোঁজের মিছিল শুরু হয়।
ফিরেই একে একে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ৬ জন ক্যাডেটকে। বেঁচে ছিলেন শুধু একজন—মেহের।
বাংলাদেশে তার প্রশিক্ষণকালে খাতায় ছিল অসংখ্য কীর্তির নাম, উচ্চতা ছিল ৬ ফুট, আর সাহসে ছিল অদম্যতা। কিন্তু তাকেও রেহাই দেয়নি সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতা। কিছুদিন পর তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া ও স্মরণ:
এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিও। যেসব প্রশিক্ষকেরা তাদের গড়ে তুলেছিলেন, তারা এই খবর শুনে শোকাহত হন। BMA-তে একাধিক দিন ধরে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়, পালিত হয় নীরবতা, স্মরণ করা হয় সেই ৭ জন তরুণের যারা বাংলাদেশের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শহীদ হয়েছিলেন নিজের দেশের জন্য।
সমাপ্তি:
এই ঘটনা শুধু ট্র্যাজেডি নয়—এ এক আন্তর্জাতিক বন্ধনের গভীর বার্তা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে যে সামরিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, তা কেবল কৌশলগত সহযোগিতা নয়, বরং এক ধরনের নৈতিক সমর্থনের প্রতিচ্ছবি।
মেহের ও তার সাথীদের স্মরণে যখন আমরা মাথা নিচু করি, তখন চোখে ভেসে ওঠে সাহস, ত্যাগ আর অসমাপ্ত স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।
আজও প্রশ্ন থেকে যায়—একটি জাতির স্বাধীনতা-চেতনায় প্রশিক্ষিত এই সাহসীদের কি প্রাপ্য ছিল কেবল মৃত্যু? আর আমাদের শিক্ষা কি হবে কেবল নীরব শ্রদ্ধা, না কি নতুনভাবে ভাবা—বিশ্ব রাজনীতির যুদ্ধে মানুষের জীবন কতটা তুচ্ছ, আর ন্যায়বিচার কতটা দূর?