বাংলার নবজাগরণ: আলোকের অভ্যুদয় না শহুরে বিভ্রম?
নবজাগরণ প্রতিবেদন:
১৮ শতকের শেষভাগ থেকে ২০ শতকের গোড়ার দিকে, উপনিবেশাধীন বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তনের ঢেউ উঠেছিল, তা ইতিহাসে "বাংলার নবজাগরণ" নামে পরিচিত। একে কেউ কেউ ‘বাঙালি রেনেসাঁস’ বললেও, এ শব্দের যথার্থতা নিয়ে আজ অনেক ইতিহাসবিদই প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, ইউরোপীয় রেনেসাঁস যেখানে শিল্প, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদী চিন্তায় বিস্ফোরণ ঘটায়, বাংলার নবজাগরণ সেখানে একটি নগরকেন্দ্রিক, উচ্চবর্ণীয় আন্দোলন হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এই নবজাগরণের সূচনায় ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, যাঁকে এর পিতা হিসেবে মনে করা হয়। পাশাপাশি ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ হিন্দু বিদ্বজ্জনেরা সামাজিক ও শিক্ষাগত সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তবে মুসলিম সমাজ এই আলো থেকে বহুটা দূরেই রয়ে গিয়েছিল। যদিও কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, মীর মশাররফ হোসেন, শহীদুল্লাহদের মতো মুসলিম মনীষীরা পরবর্তীতে চিন্তা ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে এই নবচেতনাকে নিজ নিজ প্রেক্ষিতে এগিয়ে নিয়ে যান।
নতুন শিক্ষাব্যবস্থা, সংবাদপত্রের প্রসার এবং ব্রাহ্ম সমাজ বা ইয়ং বেঙ্গলের মতো সংগঠনগুলির হাত ধরে পরিবর্তনের ধারাটি গতি পেলেও, এই আন্দোলন ছিল মূলত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দার্শনিকভাবে এটি আধুনিকতা ও যুক্তিবাদের সংমিশ্রণে গঠিত হলেও, একে ঘিরে তীব্র বিতর্কও ছিল। বিদ্যাসাগরের মানবতাবাদ, অক্ষয় দত্তের যুক্তিবাদ এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আধ্যাত্মিকতা একে অপরের পরিপূরক না হয়ে বরং দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল।
অশোক মিত্র ও অন্যান্য সমালোচকের মতে, এই নবজাগরণ প্রকৃত অর্থে সামাজিক পুনর্গঠন বা কৃষক শ্রেণির পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখেনি। বরং হিন্দু জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আরও প্রান্তিক করে তোলে। এই সীমাবদ্ধতা থেকেই প্রশ্ন ওঠে—এটি কি সত্যিকার নবজাগরণ, নাকি ব্রিটিশ প্রশাসনিক কৌশলের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এক কৃত্রিম সাংস্কৃতিক বিকাশ?
তবুও অস্বীকার করা যায় না যে, এই আন্দোলন উপমহাদেশে মুক্ত চিন্তা ও শিক্ষার প্রসারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তবে সেটি ছিল সীমিত, বিক্ষিপ্ত এবং গভীর সামাজিক শিকড়বিহীন। ফলে, একে সমগ্র সমাজের জাগরণ বলা কতটা যৌক্তিক, তা আজও গবেষণার বিষয় হয়ে আছে।
শেষ কথা:
বাংলার নবজাগরণ—এ কি আলো দেখার যুগান্তকারী সূচনা, না কি ইতিহাসের পাতায় শহুরে বুদ্ধিজীবী সমাজের এক বিভ্রান্ত আত্মপ্রতিচ্ছবি? উত্তরের খোঁজ আজও চলছে।
রিপোর্টিং ডেস্ক |